বাংলাদেশের প্রচলিত একটি জনপ্রিয় সবজির নাম হচ্ছে করলা। করলা এর তিতো স্বাদ হয়তো অনেকের পছন্দ নয়, কিন্তু এই করলা সবজিটি শরীরের জন্য কতটা উপকারী, তা জেনে আপনি অবাক হবেন। করলা কেবল রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে নয়, বরং দেহের অভ্যন্তরীণ রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়াতেও অত্যন্ত কার্যকর।
এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিত জানব করলা সবজির ভিতরে কি কি উপাদান রয়েছে এবং করলার উপকারিতা কী এবং কোনভাবে খেলে এর উপকারিতা সর্বোচ্চ পাওয়া যাবে।
করলা সবজি কি?
করলা (Momordica charantia) একটি তিতো স্বাদের সবজি, যা মূলত ট্রপিক্যাল ও সাবট্রপিক্যাল অঞ্চলে জন্মায়। করলার ইংরেজি নাম Bitter Gourd বা Bitter Melon। এটি লতানো উদ্ভিদজাত সবজি। করলার বিভিন্ন জাত ও আকৃতি রয়েছে, যেমন — ছোট, লম্বাটে, কাঁটা যুক্ত বা মসৃণ চামড়া বিশিষ্ট।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় করলা চাষ হয়। গ্রীষ্মকালেই এই সবজির উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। করলা শুধু রান্নায় নয়, আয়ুর্বেদিক ও প্রাকৃতিক চিকিৎসায়ও ব্যবহার হয়ে থাকে। এতে আমরা বলতে পারি এটি করলা সবজি শুধু একটি খাবার নয় এটি আয়ুর্বেদিক গাছ।
![]() |
করলা সবজির উপকারিতা ও এর পুষ্টিগুণ কি কি |
করলাসবজির পুষ্টি উপাদান কি কি?
করলা প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি ও আরও অনেক পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।করলা সবজিতে যেসব উপাদান রয়েছে সেসব উপাদানের প্রধান উপাদান গুলোর নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
ভিটামিন C
ভিটামিন A
ভিটামিন B1, B2 ও B3
আয়রন
ক্যালসিয়াম
ম্যাগনেসিয়াম
পটাসিয়াম
ডায়েটারি ফাইবার
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ফাইটোকেমিক্যাল
এক কাপ রান্না করা করলায় মাত্র ২০-৩০ ক্যালোরি থাকে, ফলে এটি ওজন কমাতে সহায়ক।
করলা সবজির উপকারিতা কি কি?
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে করলা সবজি সাহায্য করে।
- করলা সবজি খাবার হজমে সাহায্য করে এবং পেটের বদহজম, গ্যাস,এবং কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা দূর করে।
- করলা লিভার পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। করলা সবজি শরীর থেকে টক্সিন দূর করে এবং লিভারের কার্যকারিতা বাড়ায়।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
- করলা কিছু নির্দিষ্ট ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
- ওজন কমাতে করলা সাহায্য করে।
- রক্ত পরিষ্কার করে এবং ত্বক ভালো রাখে।
- হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে করলা ভূমিকা অপরিসীম।
- ত্বকের চুলকানি ও প্রদাহ প্রতিরোধ করতে পারে।
- ত্বক এবং চুলের জন্য বেশ উপকারী।
- রক্ত প্রবাহ ও রক্ত জমাট বাঁধা নিয়ন্ত্রণ করে এবং ক্ষতস্থানে ক্ষত গুলি দ্রুত নিরাময় করতে সাহায্য করে।
উপরে আমি শুধু করলা সবজির উপকারিতা নিয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি লাইন লিখেছি। আপনি যদি করলা সবজির উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান। তাহলে, নিচে করলা সবজির উপকারিতা বিস্তারিত লেখা হয়েছে আপনারা সেখান থেকে পড়ে নিবেন করা হলোঃ
১. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করলার ভূমিকা
করলা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য একটি প্রাকৃতিক ওষুধ। করলায় উপস্থিত ‘চ্যারান্টিন’ এবং ‘পলিপেপটাইড-P’ ইনসুলিনের মতো কাজ করে। এটি শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায়, ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে আসে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে করলা সবজি সাহায্য করে। করলায় উপস্থিত ‘চ্যারান্টিন’ এবং ‘পলিপেপটাইড-P’ ইনসুলিনের মতো কাজ করে।
প্রতিদিন সকালে খালি পেটে করলার রস পান করলে রক্তের সুগার লেভেল অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
২. হজমের উন্নতি ও কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ
করলা হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। এতে থাকা ডায়েটারি ফাইবার অন্ত্রে খাদ্য সঞ্চালন সহজ করে। এটি গ্যাস, বদহজম এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করে। নিয়মিত করলা খেলে পেট পরিষ্কার থাকে এবং হজমে সহায়তা করে।
৩. লিভার পরিষ্কার রাখে ও ডিটক্সে সহায়ক
করলা লিভার পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এটি শরীর থেকে টক্সিন দূর করে এবং লিভারের কার্যকারিতা বাড়ায়। অতিরিক্ত চর্বি ও অ্যালকোহলের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত লিভারের জন্য করলা দারুণ কার্যকর।
৪. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
করলায় প্রচুর ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা শরীরের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে। এটি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে দেহকে লড়তে সহায়তা করে। নিয়মিত করলা খেলে সাধারণ সর্দি-কাশি, ইনফেকশন দূরে থাকে।
৫. ক্যান্সার প্রতিরোধে করলার সম্ভাবনা
গবেষণায় দেখা গেছে, করলা কিছু নির্দিষ্ট ধরনের ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধিতে বাধা দিতে পারে। করলায় থাকা অ্যান্টি-ক্যান্সার ফাইটোকেমিক্যাল কোষের অস্বাভাবিক গঠন রোধে ভূমিকা রাখে।
৬. ওজন কমাতে করলার ভূমিকা
কম ক্যালোরি এবং উচ্চ ফাইবারের জন্য করলা ওজন কমাতে উপযোগী। এটি খেলে পেট ভরা থাকে, ফলে ক্ষুধা কম লাগে। করলা হজমে সহায়তা করায় ফ্যাট জমে না।
৭. রক্ত পরিষ্কার করে ও ত্বক ভালো রাখে
করলার রস রক্ত পরিশোধন করে। এটি রক্তে টক্সিন দূর করে ও ত্বককে পরিষ্কার রাখে। ব্রণ, ফুসকুড়ি ও অন্যান্য চর্মরোগ কমাতে করলার ভূমিকা রয়েছে।
৮. হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে
করলায় থাকা পটাসিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এটি খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে হার্ট ভালো রাখে।
কিভাবে করলা খেলে উপকারিতা বেশি হবে
১. করলার রস খাওয়া
প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ১/২ কাপ করলার রস পান করা করবেন। এটি আমাদের শরীরের রক্ত পরিশোধন করবে এবং যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখবে।
২. সেদ্ধ বা কম তেলে রান্না করে খাওয়া
অতিরিক্ত তেল এবং মসলা একটি ভালো উপকারী সবজিকে অপকারী করে ফেলতে পারে, তাই আমাদের অতিরিক্ত তেল বা মসলা ব্যবহার না করে করলা সেদ্ধ, ভাজি বা ভর্তা করে খাওয়া সবচেয়ে ভালো। এতে করলার পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ন থাকে।
৩. করলা চা পান
করলা প্রদেশ শুকিয়ে গুরু করে শুকনো করলার পাউডার গরম পানিতে ফুটিয়ে চায়ের মতো করে খাওয়া যায়। এটি ডিটক্স এবং ওজন কমাতে সহায়ক।
৪. কাঁচা করলা সালাদে ব্যবহার
কাঁচা করলা পাতলা করে কেটে লবণ ও লেবুর রসে ভিজিয়ে রেখে পরে খাওয়া যায়। এটি শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ বাঙালিরা এভাবে খাবেনা কারণ কাঁচা করলার স্বাদ তিতা।
৫. করলা গুঁড়া বা ক্যাপসুল আকারে খাওয়া
যারা কাঁচা করলার তিতা স্বাদ সহ্য করতে পারেন না তাদের জন্য এই টিপসটি আমি দিলাম। অনেক হেলথ স্টোরে করলার গুঁড়া বা ক্যাপসুল পাওয়া যায়। সেখান থেকে আপনারা এসব করলার গুড়া বা ক্যাপসুল নিয়ে খাবেন। এতে করে আপনাদের অপছন্দনীয় তিতা স্বাদের উপভোগ করতে হবে না।
কারা করলা খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন
- গর্ভবতী নারীরা অতিরিক্ত করলা খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। এটি গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই আপনি যদি করলা খেতে পছন্দ করেন তাহলে সীমিত পরিমাণে করল্লা খাবেন। আমি পরামর্শ দিব করল্লা খাওয়ার আগে গর্ভবতী নারীরা ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার।
- যাদের গ্যাস্ট্রিক বা আলসারের সমস্যা আছে, তাদের করলা খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- করলা কিন্তু আমাদের শরীরে রক্তচাপ কমিয়ে দেয়, তাই যারা রক্তচাপের ওষুধ খান, তাদের করলা অতিরিক্ত খাওয়া উচিত নয় কারণ এটি রক্তচাপ আরও কমিয়ে দিতে পারে। করল্লা খাওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।
করলা কখন এবং কিভাবে খাব
নিয়মিত করলা খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, এছাড়াও ত্বক এবং চুলের জন্য করল্লা খুবই উপকারী এবং হজম ভালো হয়।আবার আপনি যদি আপনার শরীরের ওজন কমাতে চান তাহলে আমি বলব আপনার খাবার তালিকায় করলা রাখা উচিত।
তবে যেকোনো খাবারের মতো, করলার ক্ষেত্রেও পরিমাণ মত খেতে হবে। করলার উপকারিতা গুণ শুনেই যে আপনি অতিরিক্ত করল্লা খাবেন এটি কিন্তু আপনার শরীরে খারাপ প্রভাবও ফেলতে পারে। তাই পরিমাণ মতো স্বাস্থ্যসম্মতভাবে করলা খেলে আপনি সর্বোচ্চ উপকারিতা পাবেন। উপরে করলা সবজি কি এবং এর উপকারিতা সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ বিস্তারিত লিখেছি এবং এটি কখন এবং কোন মানুষ খেতে পারবেনা তাও আপনাদেরকে জানিয়ে দিয়েছি। আপনার আপনার পছন্দমত রান্না করে করলা সবজিটির উপকারিতা উপভোগ করবে।